রাশেদ তার পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় ছোট থেকেই দায়িত্ববোধে পরিপূর্ণ ছিল। বাবা মারা যাওয়ার পর, সংসারের হাল ধরার জন্য তার আর কোনো উপায় ছিল না। ছোটবোনদের পড়াশোনা, মায়ের শারীরিক অসুস্থতা, পরিবারের খরচ—সব কিছুতেই রাশেদ ছিলো একক ভূমিকায়। তার বয়সের চেয়ে যেনো জীবনটা অনেক বেশি কঠিন হয়ে উঠেছিলো। সে নিজের সুখ-দুঃখের দিকে তেমন তাকানোর সুযোগ পায়নি, জীবনের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো গুরুতর এবং বাস্তবতামূলক।
রাশেদের মা প্রায়ই তাকে বলতেন, “তোর বিয়ে করার সময় হয়েছে রে বাবা। ছোটরা সব গড়ে উঠছে, এখন তোর নিজের জীবনের কথাও ভাবতে হবে।”
রাশেদ মায়ের কথার গুরুত্ব বুঝতে পারলেও নিজের জীবনের দিকে খুব একটা মনোযোগ দিতে পারছিল না। তার জীবনে একজন সঙ্গী চাই, এমন ভাবনা তার মনেও খুব কমই জেগেছে। একদিন মা তার কাছে এসে জানালেন যে, তাদের গ্রামের পাশের বাড়ির ছোট মেয়ে রাহিলা—যার কথা অনেক আগে থেকেই শোনা যাচ্ছিলো—সে-ই হতে পারে তার জীবনের সঙ্গী। মা তাকে বোঝালেন, “রাহিলা খুবই ভালো মেয়ে, আদরে বড় হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার মনের স্বচ্ছতা অসাধারণ। সে আমাদের ঘরের মান রাখবে।”
রাশেদ মায়ের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলো। সে জানে মায়ের পছন্দ সব সময় ভালো। তাই সে আর কোনো প্রশ্ন না করে, মায়ের সিদ্ধান্ত মেনে নিলো।
রাহিলার পরিবারও বিয়েতে রাজি হয়ে গেলো। রাহিলা ছিলো তাদের পরিবারের ছোট মেয়ে, অনেক বেশি আদর আর ভালোবাসায় বড় হয়েছে। তার জীবনে কোনো কষ্টের ছোঁয়া লাগেনি, সবকিছু তার জন্য খুব সহজ ছিলো। সে সবসময় হাসিখুশি আর উচ্ছল মনের মানুষ। রাশেদের মতো একজন দায়িত্বশীল ও গাম্ভীর্যপূর্ণ মানুষকে দেখে প্রথমে একটু ভয় পেলেও, পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে সে বিয়েতে রাজি হয়ে যায়।
বিয়ের দিন বড় জাঁকজমকের সঙ্গে হলো। দুই পরিবার আনন্দের সঙ্গে মিলিত হলো। রাশেদ আর রাহিলা একে অপরকে ভালোভাবে চিনতো না, কিন্তু বিয়ের দিন থেকে তাদের জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হলো। রাহিলার মনে অনেক প্রশ্ন ছিলো—সে কি এই দায়িত্বশীল এবং গম্ভীর মানুষটির সঙ্গে সুখী হতে পারবে?
বিয়ের পর প্রথম কয়েকদিন দুজনের জীবন একসঙ্গে শুরু করার চেষ্টায় কাটতে লাগলো। রাশেদ অনেক বেশি শান্ত, কম কথা বলে, সবসময় চিন্তামগ্ন থাকে। অন্যদিকে, রাহিলা সবকিছুতে আনন্দ খোঁজার চেষ্টা করে। একদিন রাহিলা রাশেদকে বললো, “তুমি সবসময় এত গম্ভীর কেন? জীবনটা এত কঠিন না। একটু হাসো তো!”
রাশেদ মৃদু হাসলো, কিন্তু তার মনে যেন একটা বোঝা থেকে গেলো। সে বললো, “তুমি বুঝবে না রাহিলা, আমার দায়িত্ব অনেক। আমি ছোটবেলা থেকেই পরিবারের সব দায়িত্ব পালন করে আসছি, এজন্য হয়তো একটু কঠিন হয়ে গেছি।”
রাহিলা বুঝতে পারলো, রাশেদকে বুঝতে হলে তাকে আরও গভীরে যেতে হবে। সে ভাবলো, "রাশেদকে শুধু তার দায়িত্বগুলো থেকে মুক্তি দিতে পারলেই সে হাসিখুশি হতে পারবে।" এরপর থেকে রাহিলা ছোট ছোট কাজ দিয়ে রাশেদের বোঝা লাঘব করতে শুরু করলো। সে পরিবারের ছোট ছোট বিষয়গুলো নিজে সামলাতে লাগলো, যাতে রাশেদ একটু স্বস্তি পায়।
ধীরে ধীরে রাশেদ দেখতে লাগলো, রাহিলা তার জীবনে শুধু দায়িত্ব নয়, আনন্দও নিয়ে এসেছে। সে বুঝতে পারলো, জীবনের ছোট ছোট আনন্দও মূল্যবান, এবং রাহিলা তাকে সেটা শিখিয়েছে। একদিন রাশেদ বললো, “তোমার হাসি আমার জীবনে এক নতুন রং এনে দিয়েছে। আমি হয়তো এত বছর দায়িত্ব পালন করতে করতে ভুলেই গিয়েছিলাম যে, জীবনের মজা কোথায়।”
রাহিলা মুচকি হেসে বললো, “তুমি আমা দায়িত্ববোধ শিখিয়েছো, আর আমি তোমাকে জীবনের আনন্দ শিখিয়েছি। আমরা একে অপরকে পূর্ণ করছি।”
রাশেদ আর রাহিলার মধ্যে ক্রমশ ভালোবাসা আর বোঝাপড়া বাড়তে লাগলো। তারা একে অপরের মধ্যে নিজেদের ভিন্নতাকে গ্রহণ করতে শিখলো। রাশেদের দায়িত্বশীলতা আর রাহিলার প্রাণবন্ততা একসঙ্গে মিলে তাদের জীবনকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে গেলো।
....................
আরো গল্প পড়ুন:
অপেক্ষার প্রহর: নীরব ভালোবাসার গল্প
স্মৃতির গভীরে হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা: এক অপূরণীয় অপেক্ষার গল্প
0 Comments